করোনায় শিশুদের মানসিক বিকাশ বন্ধের পথে

প্রকাশিত: ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০২১

করোনায় শিশুদের মানসিক বিকাশ বন্ধের পথে

এম জাকির হোসেনঃ
করোনা ভাইরাস মহামারির সময় শিশুদের অনেকক্ষেত্রে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়ার সম্ভাব্য বাহক কিংবা বাবা-মায়ের হোম অফিসে বাগড়া দেওয়া মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই বাস্তবে লকডাউনে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুগছে। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পরই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আজ দেড় বছর ধরে শিশু, কিশোর ও তরুণরা গৃহবন্দী। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই কাটছে তাদের দিন-রাত। বন্দী ঘরে কীভাবে কাটছে তাদের সময়? এমন অন্তত ১০ জন অভিভাবক ও তরুণের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। বেশিরভাগই বলেছেন, পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই আগের মতো। পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে আর স্মার্ট ফোনের ডিভাইসে গেইমস খেলে। দিন-রাতের রুটিন বদলে গেছে। অনেকের আচরণে এসেছে পরিবর্তন। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকেরা। শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বন্ধ বিনোদন কেন্দ্রগুলোও। ফলে ঘরের বাইরে শিশুদের বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। গত ডিসেম্বর কয়েকদিনের জন্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুললেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি করোনা সংক্রমন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কারণে শিশু অপুষ্টির হারও বাড়ছে। পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের উপর নির্যাতন সহিংসতায় দুর্ব্যবহার ও বেড়েছে।

 

ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এম জাকির হোসেন। থাকেন তিনার গ্রামে। তার স্ত্রী নূরজাহান আক্তার গৃহিনী। নূরজাহান তার সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সব সময় সে বাসাতেই আছে। যেহেতু স্কুলের বই পড়ার অগ্রহ কম, তাই আমার বাসায় থাকা বই থেকে একটা করে গল্পের বই ওকে দিই। ওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে প্রতিটি বই পড়া শেষ হলে ৫০ টাকা দেব। আবার কোন বই রিভিশন দিলে পাবে ২০ টাকা। এভাবে ও ২ হাজার টাকা আয় করেছে। এছাড়া আমরা রাতে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখি। আসলে আমি ওকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। তারপরও দিনের অনেকটা সময় মোবাইলফোনে কাটায়। সারাদিন ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোনেই কাটছে তার দিন। এর ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সে তো বলছে, আমরা এখন জেলে বাস করছি। এর মধ্যেই চলতে হচ্ছে, কি আর করা।

 

 

এই অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে? জানতে চাইলে হোমিও ডা. রুহুল আমীন প্রতিবেদককে বলেন, প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও পুষ্টি দরকার হয়। মস্তিষ্কের পুষ্টি হলো ভালো চিন্তা। সারা দিন ফেসবুক-ইউটিউবে থাকলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ভালো চিন্তা বাদ দিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ভর করে। আচরণ পালটে যায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে। ফলে এখনই শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ নজর দিতে হবে তরুণ শিক্ষার্থীদের দিকে। ডাক্তার আরও বলছেন, দীর্ঘক্ষণ ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ব্যবহার করলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। শিশুরা মোবাইল হ্যান্ডসেট অনেকক্ষণ ব্যবহার করলে তাদের স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। শরীরে টিউমার হতে পারে। রেডিয়েশনের প্রভাবে একটা শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ হেডফোন দিয়ে কথা বললে কানে নানা ধরনের সমস্যা হয়। তাই দীর্ঘসময় হেডফোন ব্যবহার না করাই উচিত। একটানা না শুনে বিরতি দিয়ে দিয়ে শুনতে হবে। দীর্ঘসময় মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় তাকিয়ে থাকলে চোখেরও সমস্যা হয়। অবশ্যই এ ক্ষতিগুলো খুব সহজে বোঝা যায় না, লম্বা সময় পর ধীরে ধীরে বোঝা যায়। বিশেষ করে শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস দেওয়ার সময় অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি বড়রাও মোবাইল ব্যবহারের সময় শিশুদের দুরে রাখতে হবে। কারণ মোবাইলের রেডিয়েশনটা শিশুদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। করোনার কারণে এখন তো অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে খুব একটা বের হচ্ছেন না। খুব দরকার না হলে হাসপাতালে আসেন না। ফলে চোখের যে ক্ষতিগুলো সেটা এখন আমরা ওভাবে বুঝতে পারছি না। এটা তো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, আরো বছরখানেক গেলে শিশুদের যখন চোখে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে তখন আমরা বুঝতে পারব করোনাকালীন সময়ে মোবাইল-ল্যাপটপের সামনে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে বাচ্চাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। তবে মনে করেন শারীরিক ক্ষতির চেয়েও শিশুদের মানসিক ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে। এই এক বছরে শিশুদের মারাত্মক কিছু ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মানসিক ক্ষতিটা অনেক বেশি। পাশাপাশি অনেক শিশু মোটা হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের সঙ্গে দূর্ব্যহারও বেড়েছে। এইসব বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার কথা বলছেন টাঙ্গাইলের হোমিও ডক্টরস ফোরামের সভাপতি ডা. রুহুল আমীন। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, এখনকার তরুণরা বেশ সেনসেটিভ। তাদের খুব একটা বিরক্ত না করাই ভালো। আবার তাদের লেখাপড়ার মধ্যেও রাখতে হবে। টিভি দেখা বা ঘরের মধ্যে অন্য ধরনের খেলাধুলার (লুডু, দাবা, ক্যারাম) ব্যবস্থা করতে হবে। বাবা-মা সন্তান মিলে খেলতে হবে। এখন আপনি যদি নিজেই সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে তো আপনার সন্তানও তাই করবে! সন্তানকে সময় দেওয়ার এটা কিন্তু একটা ভালো সুযোগ। পাশাপাশি যে ধর্মের মানুষ আপনি, সেখানে সন্তানকে নিয়ে ধর্ম পালন করতে পারেন। মোট কথা স্কুল বন্ধ থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠাসহ তাদের একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আনতে হবে। আকস্মিকভাবে স্কুল এবং অন্যান্য স্থাপনা বন্ধের পাশাপাশি বন্ধু এবং শিক্ষকদের সঙ্গে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার অর্থ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে ভ্রান্ত এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন থাকা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনার কারণে গৃহবন্দী হয়ে পড়ায় অনেক পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাতে পারছেন।